
লিখেছেন : রক্তিম বিপ্লবী
পৃথিবীর ইতিহাসে যে ব্যক্তিত্বরা চিরতরে স্বরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁর মধ্যে অন্যতম হল জার্মানির সর্বেসর্বা অ্যাডলফ হিটলার। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন একক ব্যক্তিত্ব এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ! বর্তমানে আমরা যে উপনিবেশ মুক্ত, সুসভ্য, সাংস্কৃতিক বিশ্ব দেখি তাঁর মূল কারিগর হল হিটলার। এখন প্রশ্ন হল এই হিটলারের কি এমন করিশ্মা ছিল যে বিশ্ব তাঁকে এখনও মনে রাখে? আর হিটলারের নাম শুনলে আজও কেন বিশ্ব ভয়, ভীতি ও শঙ্কিত হয়ে ওঠে?
হিটলারের জন্ম হয় 20 ই এপ্রিল 1889 সালে অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির ‘ব্রুনাও এম ইন’ নামক এক ছোট্ট শহরে। পিতা অ্যালয়িস হিটলার ও মাতা ছিলেন ক্লারা হিটলার। হিটলাররা অনেক ভাইবোন ছিল তাই প্রবল দারিদ্রের মধ্যেই জীবন শুরু হয়। অপুষ্টি, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণে হিটলারের কয়েকজন ভাইবোন মারা যায় তাই তাঁর মা ক্লারা হিটলারকে খুব যত্নের সঙ্গে লালন পালন করেন। অনেকে মনে করেন মায়ের অতিরিক্ত ভালোবাসা পেয়ে হিটলার একগুঁয়ে ও কট্টর হয়ে ওঠে। হিটলার তাঁর জীবনে এই একটি মানুষকেই সম্ভবত সত্যিই ভালোবেসে ছিলেন। হিটলারের পিতা হিটলারকে সরকারি কর্মচারী তৈরী করতে চান কিন্তু হিটলার চার্চের ফাদার বা শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। তাই এই বিষয় নিয়ে বাবার সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। হিটলারের যখন মাত্র 13 বছর বয়স তখন তাঁর বাবা মারা যান এবং এর কয়েক বছর পর তাঁর মা ও মারা যান।
তাই বাবা মায়ের মৃত্যুর পর 1908 সালে মাত্র 19 বছর বয়সে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে হিটলার ভিয়েনাতে আসে। সে স্বপ্ন দেখে এখানের ‘বুস আর্ট একাডেমিতে’ ভর্তি হবে, একাডেমিতে পরীক্ষা দিতে এসে বুঝতে পারে বিষয়টি অতটা সহজ নয় তাই হিটলার একাডেমিতে সুযোগ পায় নি। এই সময় বহু কষ্টে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থেকে নিজের জীবন গড়ে তোলেন। জীবনের এই উত্থল পতল সময়ে হিটলার স্টেফিনি আইজ্যাক নামে এক 16 বছরের ইহুদি মেয়ের প্রেমে পড়েন। এই মেয়ে হিটলারকে বিশেষ পাত্তা দিত না, হিটলার এই সময় এই নারীকে না পেলে আত্মহত্যা করবে এমন কথা চিন্তা করত। হিটলার অবশ্য এই নারীকে পায়নি; অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন হিটলারের ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষের এটি অন্যতম একটি কারণ। জীবনের এই চরম সময় হিটলার প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়ে উঠতে পারেনি তাই হতাশায় ভুগত এবং আত্মহত্যার কথা চিন্তা করত। হিটলারের জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যখন 1914 সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
এই বিশ্বযুদ্ধে হিটলার সৈনিক হিসাবে অংশগ্রহণ করে। রোগা চেহারা ও ভালো দৌড়াতে পারত বলে সামরিক বাহিনীর গোপন সংবাদ আদান প্রদানের কাজ দেওয়া হয়েছিল। এই কাজ খুব বিপজ্জনক ছিল তবে হিটলার এই কাজ কারত। এই কাজ করতে গিয়ে হিটলার আহত হয় এবং পরবর্তীকালে এই কাজের জন্য তাঁকে সেনার ‘আইরন ক্রস’ প্রদান করা হয়। এই ‘আয়রন ক্রস’ হিটলার সারাজীবন তাঁর পোষাকে পরিহিত করত। সুস্থ হয়ে হিটলার জানতে পারে সরকার বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছে ও ভার্সাই সন্ধিতে সাক্ষর করেছে। এই ঘটনাটি হিটলার কোন দিন ভোলে নি, ভার্সাই চুক্তিতে সাক্ষরকারীদের হিটলার দেশদ্রোহী মনে করত। সেনাতে অনেকে এইরকম মোনভাব পোষণ করত। এমতাবস্থায় দেশের চরম দুরবস্থায় এবং অসাধারণ বাগ্মিতার জোরে ধীরে ধীরে হিটলার ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছন।
এবার আসা যাক ভারতের প্রসঙ্গে, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জীবনের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে অদ্ভুত ভাবে হিটলারের মিল পাওয়া যায়। নরেন্দ্র মোদী 17 ই সেপ্টেম্বর 1950 সালে গুজরাটের ভাডনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ‘দামোদর দাস মোদী’ ও মাতার নাম ‘হীরা বেন’। ‘দ্যা ম্যান অফ দ্যা মোমেন্ট’ এর লেখক ‘এম ভি কামাথ’ এর লেখা থেকে জানা যায় শিশু বয়স থেকেই মোদী মেধাবী ছাত্র ছিল এবং পড়াশোনার ফাঁকে ভাডনগর স্টেশনে পিতার সঙ্গে চা বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করত। মোদী অল্প বয়স থেকেই ধর্মের বিষয়ে খুব উৎসুক ছিল এবং স্কুলের শেষে আরএসএসের শাখা শিবিরে অংশগ্রহণ করত।
এইসময় এক সন্ন্যাসী এসে তাঁর মাকে বলেন আপনার ছেলে পরবর্তীকালে হয় খুব বড় সন্ন্যাসী হবে না হয় খুব বড় রাজনেতা হবে। মোদী ও হিটলারের মতো সন্ন্যাসী হতে চাইত সেই উদ্দেশ্যে আঠারো বছর বয়সে ঘর ছেড়ে হিমালয়ে চলে যান। কয়েক বছর সেখানেই থাকেন, তিনি বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী হতে চান তবে বেলুড় মঠের নিয়ম অনুযায়ী স্নাতকের ডিগ্রি না থাকায় মোদীকে বেলুড় মঠে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়নি। এরপর বিভিন্ন ঘটনার পর মোদী আরএসএসের সহযোগিতায় বিজেপিতে যুক্ত হন এবং 2001 সালের পর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন। অসাধারণ বাগ্মিতার জোরে 2014 সালে মনমোহন সিং সরকারকে সরিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন।
মোদী ও হিটলার দুজনেই জীবনে প্রচুর সংঘর্ষ করে আগে বেড়েছে। দুজনেই অসাধারণ বাগ্মি। বৈপরীত্যের দিক থেকে বলতে হয় হিটলারের মধ্যে কট্টরপন্থা থাকা সত্ত্বেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে জার্মানিকে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করেছিলেন। অন্যদিকে মোদী সরকার শুধু বড় বড় ঘোষণা ও ভাষণ ছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কাজের কাজ কিছু করতে পারেনি। এবার আসা যাক বর্তমান প্রেক্ষাপটে হিটলারের শাসনের সঙ্গে মোদীর শাসনের তুলনামূলক আলোচনা হয় কেন? হিটলার একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। মোদী ও একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। যদিও পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসিতে, বর্তমান বিশ্বে হিটলারের মতো এতোটা এগোনো সম্ভব নয় তবুও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন!
হিটলার বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের জন্য ইহুদি, কমিউনিস্ট ও রাজতন্ত্রকে দায়ী করেন। ধীরে ধীরে সকল বিরোধী দলকে দমন করে ও তাদের নিষিদ্ধ করে একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে হিটলার সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর আচরণ করে ইহুদিদের উপর। তাদের উপর একের পর এক অমানবিক আইন চালু করতে থাকে যার মধ্যে সর্বাধিক কুখ্যাত আইন ছিল 1935 সালের ‘নুরেমবার্গ আইন’! এই আইন অনুসারে হিটলার জার্মানির ইহুদিদের নাগরিকত্ব খারিজ করে, তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, জার্মান বা জার্মান জাতির রক্তের ব্যাক্তিদের সঙ্গে ইহুদিদের বিবাহ বা যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইহুদি ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের বিতাড়িত করা হয়। তাঁদের নামের আগে সারাহ লিখতে বাধ্য করা হয় এবং তাঁদের পাশপোর্টে লাল অক্ষরে ‘J’ লেখা থাকত। তাঁদের দেশের বাইরে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় এবং তাঁদের ‘কনসেনেট্রশন ক্যাম্পে’ রাখা হত। সেখানে গ্যাস চেম্বারে লক্ষ লক্ষ ইহুদিদের হত্যা করা হয়। হিটলার প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদিদের এইরকম চরম বর্বরতার সঙ্গে হত্যা করে! হিটলার পৃথিবী থেকে ইহুদিদের মুক্ত করার সংকল্প নিয়েছিল! হিটলার বিশ্বযুদ্ধে জিতলে হয়তো পৃথিবী ইহুদি মুক্ত ও হয়ে যেতে পারত! যদিও হিটলার কিন্তু বলেছিলেন এই নাগরিকত্ব আইন ইহুদিদের পক্ষে মঙ্গলকর হবে! কি কিছু বুঝতে পারছেন কি?
হিটলার আর্য রক্তের বিশুদ্ধতার কথা বলতেন। তিনি তাঁর জাতিকে অনার্যদের হাত থেকে রক্ষা করতে ‘ব্লাড প্রটেকশন অ্যাক্ট’ চালু করেন। এর ফলে দেশের জনসাধারণকে তাঁর চার পুরুষের কেউ ইহুদি বা বিদেশি নয় তা প্রমাণ করতে হত না হলে ডিটেনশ্যান ক্যাম্প ও কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হত। কি এনআরসির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কি? যদি ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, যে হিটলার ইহুদিদের উপর এত ঘৃণা ও এত বর্বরতা প্রদর্শন করেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষরা ও ইহুদি বংশোদ্ভূত ছিল। তবে হিটলার যেটা করেছিলেন তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতার জোরে এই সমস্ত অমানবিক কাজ কর্মকে মানুষের চোখে বৈধ স্বীকৃতি দিয়েছিল। আসলে সমাজে জার্মান, অ-জার্মান, ইহুদি ইত্যাদির নামে এত ঘৃণার প্রসার ঘটিয়েছিলেন যে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুতে ও সাধারণ মানুষের কিছু এসে যায়নি, হয়তো ঘৃণ্য ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা এমন ভাবেই প্রসারিত হয়!
এবার ভারতের প্রেক্ষাপটে আসা যাক অনেকে মনে করছেন জার্মানির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কি? তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি যথেষ্ট সম্পর্ক রয়েছে কারণ বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আরএসএস এই নাৎসি বাহিনির সমর্থক ছিল। আরএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও চিন্তাবিদ এমএস গোলওয়ালকর তাঁর বিখ্যাত বই- ‘উই আর আওয়ার নেশান হুড ডিফাইন’ এ একথা লিখেছেন- ‘জার্মানি বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে সে দেশ থেকে সেমেটিক জাতির মানুষদের বহিষ্কার করার মধ্যমে ইহুদিদের। জার্মানি দেখিয়েছে কিভাবে প্রায় অসম্ভব জাতিসমূহ ও সংস্কৃতি গুলির, শিকড় পর্যন্ত যার বিচ্ছিন্নতা, তাকে একটা সামগ্রিক সত্তায় আত্মীকরণ ঘটানো। আমাদের হিন্দুস্তানের ক্ষেত্রে এটা খুব ভালো শিক্ষা এবং তার ফায়দা তুলতে হবে। (পৃঃ- 87-88)
গোলওয়ালকর হিন্দুরাষ্ট্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন- যারা জাতির অন্তর্ভুক্ত নয় অর্থাৎ হিন্দু জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ভাষা স্বাভাবিক ভাবে তারা প্রকৃত জাতীয় জীবনের আঙ্গিনার বাইরে’। (পৃঃ- 99) তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন- যে সকল জনগণকে বিদেশি হিসাবে গণ্য করা হবে, যদি তারা তাদের জাতিগত, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখে।’ (পৃঃ- 107)
আরএসএসের মতাদর্শদাতা এরপর আরও স্বচ্ছভাবে বললেন: ‘হিন্দুস্তানের বিদেশি জাতিগুলিকে অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষাগ্রহণ করতে হবে, অবশ্যই শিখতে হবে হিন্দুধর্মের প্রতি সন্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গরিমা বৃদ্ধিকারী ব্যতিরেকে অন্য কোন আদর্শ লালন করা যাবে না। অর্থাৎ হিন্দু রাষ্ট্রের এবং তাদের পৃথক সত্তা বর্জন করতে হবে হিন্দু জাতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য, বা দেশে থাকতে পারেন সম্পূর্ণত হিন্দু রাষ্ট্রের অধীনে, কোন কিছু দাবি না করে, কোনও সুবিধা ভোগ না করে, কোন রকম অগ্রাধিকারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে- এমনকি নাগরিক অধিকার পর্যন্ত (পৃঃ- 105)।
তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আরএসএস ভারতকে কি রকম হিন্দু রাষ্ট্র এবং হিন্দু ছাড়া সকল জাতিকে ভারত থেকে বিতাড়িত করতে চাই। তাঁর জন্য যে কোন বর্বরতা প্রদর্শন করতে তাঁরা পিছপা হন না। আরএসএসের এই বিভাজনকারী চিন্তারই ফসল হল সিটিজেনসিপ অ্যামেন্ডমেন্ট আইন 2019 (CAA), এনআরসি ও এনপিআর ইত্যাদি। এখন যেটা নিয়ে দেশ সবচেয়ে বেশি উতপ্ত তা হল নাগরিক সংশোধনী আইন 2019 (CAA). এখন প্রশ্ন হল এই CAA নিয়ে এত বিতর্ক কেন? যেখানে সরকার বলছে এই বিল কোন ভারতীয় মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরন করবে না এখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় দিক থেকে প্রতারিত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান ও পারসি ধর্মের লোককে 2014 সালের 31 শে ডিসেম্বরের মধ্যরাতের আগে এদেশে এসেছে তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। সাধারণত 11 বছর থাকলে ভারতের নাগরিকত্ব মেলে কিন্তু এক্ষেত্রে 6 বছরে নাগরিকত্বের সুযোগ দেওয়া হবে কেন?
এখানে বহু বিষয় যুক্ত রয়েছে একশ্রেণীর হিন্দুত্ববাদীরা এটা প্রচার করার চেষ্টা করছে এই আইনে ভারতীয় মুসলমানদের কোন সমস্যা নেই এবং এটা অন্যদেশে প্রতারিত সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদানের আইন, কাড়ার নয়। হ্যাঁ, বিষয়টি সত্যিই শুনতে ভালো যে প্রতারিতদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কিন্তু এর ভিতরের জটিলতা বোঝা খুব প্রয়োজন। প্রথমত সরকার এনআরসি পরিকল্পনা তিনটি পর্বে সম্পন্ন করতে চাই এক এনপিআর- জাতীয় সংখ্যা পঞ্জি এর ফলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন মানুষকে চিন্হিত করা হবে, এটি এনআরসির প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তীতে দেশজুড়ে এনআরসি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে এবং এই এনআরসিতে যারা বিদেশি হিসাবে চিহ্নিত হবে, তাঁদের সিএএ এর মাধ্যমে মুসলমান বাদে সকলকে ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। অর্থাৎ এই আইন পুরোপুরি ভারতকে মুসলমান মুক্ত করার এক সাম্প্রদায়িক আইন! এই আইন হিটলারের নুরেমবার্গ আইনের প্রতিভূ!
এবার আসা যাক সিএএ আইনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। সিএএ আইনে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, পারসি ধর্মের লোকেদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বললে ও মুসলমান, নাস্তিক বা ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মের প্রতারিতদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয় নি কেন? এটি কি ভারতের সংবিধানের 14 নম্বর ধারায় ‘আইনের চোখে সকলে সমান’, এই আদর্শ লঙ্ঘন করে না? সংবিধানের 15 নম্বর ধারায় যে বলা হয়েছে ‘আইনে কারোর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না’, তা কি লঙ্ঘন করে না? এটি ভারতের প্রস্তাবনায় ভারত একটি ‘সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজতন্ত্ররূপে’ যে বর্ণনা করা হয়েছে তা লঙ্ঘন করে না? এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধানের উপর আঘাত নয়?
এবার প্রশ্ন হল সরকার বেছে বেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে বাছলো কেন? ভারতের পার্শ্ববতী দেশ হিসাবে শ্রীলঙ্কা বা মায়ানমারকে রাখলো না কেন? আসলে সরকার এখানে খুব সুকৌশলে হিন্দু মুসলমান বিভাজনের রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। বর্তমানে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সরাসরি সীমান্ত নেই, এটি পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে গেছে অথচ এটি মুসলমানদের দেশ হিসাবে এই লিস্টে রয়েছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কাতে যেখানে তামিলরা বৌদ্ধদের দ্বারা নির্যাতিত হয়, সে দেশ এই লিস্টে নেই কেন? অন্যদিকে মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানরা অন্যতম নিপীড়িত জাতি এই দেশগুলিকে এই লিস্টে রাখা হয়নি কেন? কারণ এই দেশগুলিতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু তাই তাঁরা এর আওতায় আসতে পারে। তাই সরকার তাঁর জঘন্য, হিংস্র, সাম্প্রদায়িক নীতির কারণে এই বিভাজনকারী আইন এনেছে! এবার প্রশ্ন হল মুসলমানরা কি এইসব দেশে নির্যাতিত হননি?
পাকিস্তানে আহমেদীয়া মুসলমান, শিয়া বা নাস্তিকরা কি নির্যাতিত হননি? বাংলাদেশে বিভিন্ন মাজারপন্থী, ও মুক্তচিন্তকরা কি নিগৃহীত হননি? আফগানিস্তানের পূর্বতন প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাকে কি তালিবানরা মেরে ল্যাম্প পোস্টে টাঙিয়ে দেন নি? তাঁদের পরিবার কি প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আসতে বাধ্য হয়নি? তাহলে সরকারের ইচ্ছা কি?এবার প্রশ্ন হল বাংলাদেশের মুক্তচিন্তা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত তসলিমা নাসরিনকে সরকার কি হিসাবে দেখবে মুসলিম না মুক্তচিন্তক? তাঁর নাগরিকত্বের কি হবে? পাকিস্তানের তারেক ফতের মতো মানুষদের নাগরিকত্বের কি হবে? পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে যাঁরা নির্যাতিত হয়ে ভারতে আসবে তাঁদের নাগরিকত্ব কেন পুরানো আইন অনুসারে দেওয়া হবে? অর্থাৎ আপনি যদি অস্ট্রেলিয়া থেকে হিন্দু হওয়ার অপরাধে নিগৃহীত হয়ে ভারতে আসেন সেক্ষেত্রে নাগরিকতা পেতে 11 বছর সময় লাগবে। আবার এই আইন উত্তরপূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে গণ্য করা হবে না। অর্থাৎ একটি দেশে একাধিক আইনের সূত্রপাত যা দেশে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবে!
সরকার যদি কোন ধর্ম উল্লেখ না করে বলত পৃথিবীর যেকোন দেশ থেকে নিগৃহীত মানুষদের 6 বছরে নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে তাহলে কোন বির্তকের সৃষ্টি হত না কিন্তু সরকার তা না করে ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতির জন্য এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে এই সাম্প্রদায়িক আইন আনেন। এখন প্রশ্ন হল তারা যে সত্যি নিগৃহীত হয়েছিলেন তা প্রমাণ হবে কি করে? এখন অন্য সরকার এসে যদি এই আইন বাতিল করে দেয় তখন এই সমস্ত মানুষের নাগরিকত্বের কি হবে? যারা এমনিতে নাগরিক তাঁরা আবার কেন নাগরিকত্বের আবেদন করবে? তাই এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিবাদ সংগঠিত করা উচিত। যা দেখাও যাচ্ছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ। তবে এই বিরোধ যেন শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে হয় তা দেখতে হবে, না হলে সাম্প্রদায়িক শক্তি একে কাজে লাগিয়ে মানুষের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা করবে ও সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত শক্ত হবে!
এবার অনেক হিন্দুত্ববাদীরা বলতে শুরু করেছে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়েছে তাহলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যদি মুসলমান রাষ্ট্র হয় তাহলে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হতে ক্ষতি কি? এখানে বলা ভালো ঐতিহাসিক আঙ্গিকে দেখলে বলা যায় ভারতের বিভাজন উপমহাদেশের ইতিহাসে এক চিরস্থায়ী ক্ষততে পরিণত হয়েছে। ভারত বিভাজন ভারতের এক বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠী চাইনি, তাঁরা দেশ ভাগের পর ভারতেই থেকে যায় এবং বহু মুসলমান পরিবার যাঁরা মুসলমান প্রধান পাকিস্তানে না থেকে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে থাকার জন্য লাহোর, করাচি ইত্যাদি প্রদেশ থেকে ভারতে আসে। যেমন বিশিষ্ট অভিনেতা শাহরুখ খানের পরিবার পাকিস্তান থেকে আসে। আবার তৎকালীন সাম্প্রদায়িকতার পরিপ্রেক্ষিতে বহু জাতীয়তাবাদি রাষ্ট্রনেতা চোখের জল মুছতে মুছতে পাকিস্তানে যুক্ত হতে বাধ্য হন। যেমন বিশিষ্ট গান্ধীবাদী নেতা খান আব্দুল গফফর খানের পরিবার আজও পাকিস্তানকে মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা এখনও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস হল পাকিস্তান প্রচেষ্টার প্রধান রূপকার মহম্মদ আলি জিন্না ও কিন্তু পাকিস্তান চাইনি। মহম্মদ আলি জিন্না ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র। তিনি ছিলেন আইনজীবি, মহম্মদ আলি জিন্না যেটা চেয়েছিল আইনের প্যাঁচে ফেলে পাকিস্তান প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভ, কিন্তু 1946 সালের 16 ই আগস্ট কলকাতায় ‘ডাইরেক্ট একশন ডে’র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরপর নোয়াখালী, বোম্বাই, বিহার, পাঞ্জাব ভারতের সর্বত্র দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশভাগ প্রায় আসন্ন হয়ে ওঠে। এই দাঙ্গা বহু রাজনৈতিক সমীকরণ ঘেঁটে দেয়। একদিকে জিন্নার পাকিস্তান প্রস্তাব, অন্যদিকে হিন্দুমহাসভার যেকোন মূল্যে জিন্নাকে ক্ষমতা থেকে বাদ রাখার জন্য দেশভাগে সম্মতি, অন্যদিকে কংগ্রেসের এক হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী মুসলিম লীগের হাত থেকে রক্ষা পেতে ভারত বিভাজনে প্রচ্ছন্ন মদত, অন্য একটি গোষ্ঠী যে কোন মূল্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার লোভ এবং কনজারভেটিভ নেতা উইনস্টল চার্চিলের জিন্নাকে ক্রমাগত পাকিস্তানের জন্য উৎসাহ দান এবং ভারত বিভাগের ষড়যন্ত্র। লেবার প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি যদিও অখণ্ড ভারতের পক্ষে ছিলেন কিন্তু চার্চিল যেকোন মূল্যে ভারতবাসীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ভারত বিভাজন চেয়েছিলেন। তাই এতগুলি পরস্পর বিরোধী শক্তির কারণে ভারত বিভাজন সম্পন্ন হয়। তাই ভারত বিভাজনের জন্য জিন্না একা দায়ী একথা বলা অতিশয়োক্তি হবে, তবে এটা ঠিক তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও যেকোন মূল্যে ক্ষমতা লাভের বাসনা ভারত বিভাজনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
তবে প্রশ্ন হল জিন্না কি সত্যিই পাকিস্তান চেয়েছিলেন? ঐতিহাসিক আঙ্গিকে বলতে হয় জিন্না কিন্তু অর্ধেক পাঞ্জাব ও অর্ধেক বাংলা শুদ্ধ পাকিস্তান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে জিন্না নিজেই জানতেন না তিনি পাকিস্তান চান কি না? রাজনৈতিক দাবার চাল হিসাবে পাকিস্তান এক জিনিস এবং সত্যি সত্যিই বাস্তবে পাকিস্তান গঠন আর এক জিনিস। তাই যখন দিল্লিতে শেষ বারের মতো মুসলিম লীগের সভা বসল তখন দেশব্যাপী বিভিন্ন শহর থেকে আসা মুসলিম লীগের কর্মীরা বলল আমাদের কি হবে? জিন্নার কাছে এর কোন উত্তর ছিল না তিনি শুধু বললেন ‘হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্কের উপর এখানকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নির্ভর করবে’। জিন্না এই সময় নবগঠিত পাকিস্তানে যান এবং তিনি প্রথমে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ও সকল নাগরিকের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার কথা বলেন। হ্যাঁ পাঠক অবাক হলেও এটাই সত্য জিন্না কিন্তু পাকিস্তানকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। লালকৃষ্ণ আডবাণী জিন্নার এই বিষয়গুলিকে মাথায় রেখেই তাঁকে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ বলে মনে করেছেন! তাহলে প্রশ্ন হল জিন্না যদি পাকিস্তানকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তাহলে পাকিস্তান তৈরী করলেন কেন?
তাই প্রকৃতপক্ষে বলা যায় জিন্না এক স্ববিরোধী চরিত্র। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ধার্মিক মুসলমান ছিলেন না, নামাজ পড়তে কেউ কোন দিন জিন্নাকে দেখেনি, তিনি মদ্যপান করতেন এবং শুকরের মাংস খেতেন এমন এক মানুষ মুসলমানদের দাবিকে সামনে রেখে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান বানিয়েছিলেন অথচ পাকিস্তান গড়ে তুলেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে। ঠিক এই কারণে বেশ কয়েকবার তাঁর উপর হামলা চালানো হয়, তবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। 1948 এর এপ্রিল মাসে পেশোয়ারে খোলা ময়দানে বক্তৃতা দেবার সময় জিন্না একেবারে কাক-ভিজে যান তাঁর বোন ফাতিমা জিন্না বুঝতে পারেন বিপদ ঘনিয়ে আসছে!
এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এইসময় জিন্নার বারবার মনে হতো তিনি পাকিস্তানের জন্ম দিয়ে বিরাট ভুল করেছেন। তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে সেকথা বলতেন কিন্তু তখন সম্ভবত তাঁকে আর কেউ বিশেষ গুরুত্ব দিত না, তিনি এই সময় মাঝে মাঝে ভারতবর্ষের পুনর্মিলনের কথা বলতেন। তিনি এইসময় বলতেন তোমরা জান না আমি কতটা বোম্বাইকে ভালোবাসি, সেখানে আমার ‘জিন্না হাউস’ আছে। আমি সবকিছু ছেড়ে বোম্বাইয়ে আমার ‘জিন্না হাউসে’ চলে যাব। নেহেরু আবার মনে করত ভারত বিভাজন সাময়িক বিষয় এটি পরে ঠিক হয়ে যাবে। এই সময় জিন্না যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন এবং ধীরে ধীরে তা ফুসফুসে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে। জিন্না বেলুচিস্তানের জিয়ারত শহর থেকে করাচি ফিরে আসে এই সময় বাড়ি যাওয়ার পথে তাঁর শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই সময় এমন একটি অ্যাম্বুলেন্স আসে যেখানে কোন নার্স ছিল না এই অ্যাম্বুলেন্সটি মাঝ রাস্তায় খারাপ হয়ে যায় এবং অনেক বলা সত্ত্বেও অন্য অ্যাম্বুলেন্স কয়েক ঘন্টা পরে আসে এতে জিন্নার অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক হয়ে পড়ে এবং ওই দিন 11 ই সেপ্টেম্বর 1948 সালে রাত্রি দশটার সময় জিন্নার মৃত্যু হয়। জিন্নার মৃত্যু কি স্বাভাবিক ছিল নাকি তাঁকে পরিকল্পনা করে মারা হয়েছিল এ নিয়ে পাকিস্তানে আজও বিতর্ক রয়েছে?
তবে অনেকে মনে করেন সব মুসলমান পাকিস্তান প্রস্তাবে জিন্নাকে সমর্থন করেছিল বিষয়টি তা নয় জিন্নাকে পাকিস্তান বিষয়ে সবচেয়ে বড় ঝটকাটি লাগে নিজের মেয়ে দিনা ওয়াদিয়ার কাছ থেকে। জিন্নার মেয়ে দিনা জিন্না এক পার্শি নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করেন। জিন্না তখন তাঁর মেয়েকে বলেন তুমি বিয়ে করার জন্য ভারতের এক মুসলমান ছেলে পেলে না? দিনা তখন প্রত্যুত্তরে বলেন আপনি ও দ্বিতীয়বার বিয়ে করার জন্য আর একটি মুসলিম মেয়ে খুঁজে পেলেন না? দিনার এই কথার জিন্নার কাছে কোন জবাব ছিল না, ইতিহাস সাক্ষী তাঁর এই সন্তান কোন দিন পাকিস্তানে জাননি। জিন্না মৃত্যুর মুখে তাঁর মেয়েকে দেখতে চান কিন্তু তাঁর আর সে দেখা হল না, দিনা ওয়াদিয়া একবারই মাত্র পাকিস্তানে গিয়েছিলেন বাবার দেহ সমাধিস্থ করতে। তিনি সারাজীবন ভারতেই থাকেন এবং আজও জিন্নার সন্তানের এই বংশধরেরা মুম্বাইয়ে থাকেন।
পাকিস্তান পরবর্তীকালে সেনাশাসক জিয়াউল হকের আমলে ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তানে পরিণত হয় এবং এই জিয়াউল হকের আমল থেকেই পাকিস্তান মধ্যযুগীয় এক ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাই দেশভাগের পর পাকিস্তান এক ইসলামি দেশে পরিণত হয়েছিল এটা বলা ঐতিহাসিক আঙ্গিকে সঠিক হবে না, তবে এটা সত্য এই দেশের মূল চালিকাশক্তি ছিল ইসলাম। পাকিস্তানের অপর এক নায়ক বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই সোহরাওয়ার্দীর আমলেই কলকাতায় গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং সংগঠিত হয়, বলা হয় যে সোহরাওয়ার্দী পুলিশকে সঠিকভাবে কাজ করতে দেয়নি। তাঁর এই জঘন্য কর্মকান্ডে কলকাতা মৃতের নগরীতে পরিণত হয়। তবে যখন পাল্টা উভয় সম্প্রদায়ের গুন্ডারা কলকাতা অধিকার করে তখন গান্ধীজি কলকাতার দাঙ্গা রুখতে আমরণ অনশন শুরু করে, এই সময় সোহরাওয়ার্দী গান্ধীজির শান্তি প্রতিষ্ঠার কর্মসূচিকে সমর্থন করে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
তবে অনেকেই গান্ধীর পাশে এইসময় সোহরাওয়ার্দীকে দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অনেকে মনে করে এইসময় থেকে সোহরাওয়ার্দীর মনের পরিবর্তন শুরু হয়। সম্ভবত কলকাতার দাঙ্গা সোহরাওয়ার্দীকে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করেছিল। অদ্ভুত বিষয় হল পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম এই রূপকার পাকিস্তান তৈরী হওয়ার পর পাকিস্তানে গেলেন না তিনি কলকাতাতেই থেকে যান এবং ভারতের নাগরিক হিসাবে থাকবেন বলে স্থির করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন ভারত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অন্যান্য মামলার তদন্ত শুরু করে তখন মামলা থেকে রক্ষা পেতে সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়। আসলে এই সমস্ত কথা থেকে এটাই প্রমাণিত হয়- যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান তৈরী করতে চেয়েছিল তাদের ধারণা ছিল না দাবার ঘুটি হিসাবে পাকিস্তান এক জিনিস ও বাস্তবের পাকিস্তান অন্য জিনিস। তাই যখন সত্যিই পাকিস্তান তৈরী হল তখন তাঁরা বুঝতে পারেন কি ভুলই না করে ফেলেছেন। তাঁদের এই ভুলের বোঝা পাকিস্তানকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বইতে হচ্ছে।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে 1971 সালে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বিশ্বের মানুষের কাছে মর্যাদার সঙ্গে গৃহীত হয়। কিন্তু মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও সেনাশাসক এরশাদ ক্ষমতায় আসে। এরা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মান্ধ সংবিধান চালু করে, এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করে দেশকে মৌলবাদের দিকে ঠেলে দেয়। তাই ভারত ভাগ হয়েই পাকিস্তান বা বাংলাদেশ চরম মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয় এটা সঠিক বিশ্লেষণ নয় বরং বলা ভালো এরা ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ধরে রাখতে ব্যার্থ হয়।
আর এরফলে এই দেশগুলি অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়! আর এঘটনা থেকেই স্পষ্ট ভারত ভাগ সঠিক ছিল না এটি এক ভ্রান্ত ধারণার উপর গড়ে উঠেছে যা উপমহাদেশের মানুষের তীব্র ক্ষতি করেছে। এখন প্রশ্ন হল এটি থেকে আমরা কি শিক্ষা নেব? আমরা কি পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হব নাকি আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশে পরিণত হব? যদি আমরা পাকিস্তান হতে চাই তাহলে ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করব কিন্তু যদি আমরা উন্নত দেশ হতে চাই তাহলে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ থাকতেই হবে। তাই এই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষকে রক্ষার জন্যই আমাদের এই সংগ্রাম, আমাদের এই ত্যাগ তিতিক্ষা!
একশ্রেণীর সাম্প্রদায়িক মানুষরা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো দেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তাঁর জন্য ভারতবর্ষকে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতে হবে এটা কতটা যৌক্তিক? মৌলবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর অন্যতম অনুন্নত দেশের মধ্যে পড়ে রয়েছে, তা ভারতকে কি আপনারা এইরকম অনুন্নত পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মধ্যে রাখতে চান? প্রকৃতপক্ষে এই সব দেশের মৌলবাদী শক্তি গুলিকে যদি হারাতে চান তাহলে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল এইসব দেশে যে সব মুক্তচিন্তকরা আক্রান্ত হচ্ছে তাঁদের ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করা এবং এদের সহযোগিতায় এক ধর্মমুক্ত, কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। অথচ ভারত সরকার তাঁর উল্টো কাজ করছে, ভারত সরকার এদেরকেও মুসলমান হিসাবে চিন্হিত করে এই মুক্তচিন্তার আন্দোলনকে দুর্বল করছে!
আর একশ্রেণীর হিন্দুত্ববাদীরা মনে করছে এভাবে ইসলামি মৌলবাদকে রুখে দেওয়া সম্ভব। প্রকৃত পক্ষে এগুলি শিশু সুলভ চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়, এভাবে মুসলিম মৌলবাদীদের রোখা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সুপার পাওয়ার শক্তিরা তা পারেনি তাহলে আমাদের পক্ষে ও তা পারা ভীষণ কঠিন! ইসলামি মৌলবাদ তখনই শেষ হবে যখন আমরা ভালোবেসে, যুক্তি দিয়ে তাঁদের আদর্শের অসাড়তা প্রমাণ করব তখনই সমাজ পরিবর্তন হবে নচেৎ নয়। আমাদের লেখা পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের চেতনার পরিবর্তন হচ্ছে তাঁরা ধর্মান্ধতা মুক্ত হচ্ছে, এটাই আশার কথা। তাই ভালোবাসা, সহানুভূতি ও যুক্তি দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব ঘৃণা ও গালি দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই ইসলামি মৌলবাদের পাল্টা হিন্দুত্ববাদ হতে পারে না। একটা অন্যায়ের প্রতিবাদে অন্য অন্যায় কখনোই যৌক্তিক নয়। তাই ভারতবর্ষের গুরুত্ব অনেক বেশি উপমহাদেশের সুপার পাওয়ার হওয়ার জন্য ভারতের দায়িত্ব অনেক বেশি তাই ভারতকে তাঁর ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটি তখনই সম্ভব যখন ভারত ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার গণতান্ত্রিক মতাদর্শ গ্রহণ করবে এবং সকল প্রতারিতদের নাগরিকত্ব প্রদান করবে! তখনই প্রকৃতপক্ষে ভারত আবার জগত সভার শ্রেষ্ঠ আসন লবে!
কিন্তু মোদী শাহ জুটি মনে হয় এই কথাগুলি বিশ্বাস করেন না তাঁরা মানুষের মধ্যে ঘৃণা ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। তাঁরা হিটলারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নাগরিক সংশোধনী আইন ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ঘৃণার প্রসার ঘটাতে সমর্থ হয়েছে। একশ্রেণীর মানুষ মনে করছে এতে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের কি আছে? তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি সাধু সাবধান। এরা প্রথমে মুসলমান মুক্তর কথা বলছে, পরবর্তীকালে খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন মুক্ত ভারতের দিকে এগোবে এবং তখন শুধুই হিন্দুরা থাকবে। হিন্দুদের মধ্যে ও মনুবাদী মতাদর্শ অনুসারে শূদ্ররা চিরকাল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, ও বৈশ্যদের গোলামি করবে। কারণ ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয় এবং উরু থেকে বৈশ্য এবং পদ যুগল থেকে শূদ্ররা সৃষ্টি হয়েছে। তাই ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে শূদ্ররা চিরকাল পদ দলিত হয়েই থাকবে!
তাই এই ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরাবৃত্তি দলিত ও শূদ্রদের পক্ষে মারাত্মক হবে তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবে। মহিলাদের উপর নেমে আসবে চরম নিপীড়ন, মনুবাদীরা মহিলাদের স্বশক্তির বিপক্ষে। এরা মনে করে মেয়েরা শুধুমাত্র গৃহে সন্তান প্রতিপালন করবে এদের সমাজে উচ্চশিক্ষা এবং উচ্চকর্মের কোন প্রয়োজন নেই! আগামী দিনে হয়তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে, ক্রিসমাস ডে, পার্টি সেলিব্রেশন, ডিস্কো যাওয়া, নিউ ইয়ার ইভ পালন ইত্যাদি পশ্চিমা সংস্কৃতি বলে এগুলি বন্ধ করে দেবে! তাই আজ বিষয়টি শুধু হিন্দু মুসলমান নয় বিষয়টি হল সুস্থ ভাবে সকলের বেঁচে থাকা, বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা ও গণতন্ত্র সুরক্ষিত রাখার লড়াই। আপনি কি চান দেশ আদিম, অন্ধকার সময় পড়ে থাকুক না আধুনিক বিশ্বের শক্তিশালী ভারতে পরিণত হোক?
অনেকে ভাবছেন আমরা হিন্দু আমাদের কিছু হবে না তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি মূর্খের স্বপ্ন দেখছেন। আসামের ঘটনা থেকে শিক্ষা হয়নি? এখানে 19 লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় 13 লক্ষ হিন্দু বাদ পড়েছে, তাহলে বিজেপি হিন্দুদের রক্ষা করল কি করে? বিপদে সকলে পড়বে কারণ গরীব মানুষের কাছে উপযুক্ত ডকুমেন্ট নেই এবং আসামের মতো বিভিন্ন প্রদেশে যেখানে প্রতিবছর বন্যা হয় সেখানে কি করে ডকুমেন্ট সামলে রাখা সম্ভব? তাই সকল মানুষের কাছে আবেদন এটা হিন্দু মুসলমানের বিষয় নয় এটা ‘মানবতার সঙ্কট’! তাই আজ যদি আপনি এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ান আগামী দিনে তাঁর ফল ভোগ করতে হবে। অনেকে কিছু হিংস্র ঘটনার প্রতিবাদে বিরক্ত হচ্ছেন আমি ও আপনাদের সঙ্গে একমত এই হিংস্র প্রতিবাদ সমর্থন করি না। অনেকে প্রতিবাদটিকে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগ করে দেখছে কিন্তু আমার প্রশ্ন হল আপনার মনে যদি দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার ভয় থাকে তাহলে কি আপনি পারবেন চুপ করে বসে থাকতে? তবে যাই হোক এই হিংস্র প্রতিবাদ কখনোই কাম্য নয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ সংগঠিত হওয়া উচিত। সরকার বলছে এই প্রতিবাদে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে এটা সত্যিই উচিত নয় কিন্তু এই সরকারই যেভাবে দেশের সরকারি সম্পত্তি বিএসএনএল, এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি পুঁজিপতিদের হাতে বেঁচে দিচ্ছে তাঁতে তাদের মুখে একথা মানায় না।
একদিকে দেশজোড়া প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই প্রতিবাদকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু যে তৃণমূল কংগ্রেসের 8 জন সাংসদ পার্লামেন্টে সিএবির ভোটের সময় অনুপস্থিত ছিল এবং যে মমতা ব্যানার্জি সরকার রাজারহাট ও বনগাঁতে ডিটেনশন ক্যাম্পের জন্য জমি চিন্হিত করে রেখেছিলেন এবং NPR এর জন্য প্রশাসনিক পর্যায়ে তৈরী ছিলেন, তাঁরা এই এনআরসির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সত্যিই কতটা আন্তরিক সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন? দিল্লি গেলেই সারদার তদন্তের গতি কমে যায়, অন্যদিকে বিজেপির মিছিল পুলিশ শক্ত হাতে দমন করে না, অন্যদলের মিছিলে পুলিশ লাঠি চালায় এগুলি কিসের নিদর্শন? সামনে কুস্তি পিছনে দোস্তির মতো ঘটনা নয় তো? জনগণের বিশেষ সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আর এটা তো সর্বজনবিদিত মমতা ব্যানার্জির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণেই বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত তাই সকলকে আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন!
এবার প্রশ্ন হল সরকারের এই নীতি আনার কি প্রয়োজন ছিল? চাপে পড়ে মোদী এখন বলছেন তাঁর সরকার এনআরসি নিয়ে কোন কথা বলে নি। তাঁর সরকার কোন ডিটেনশ্যান ক্যাম্প করেনি অথচ সরকার লোকসভায় জানিয়েছে আসামে ছয়টি ডিটেনশ্যান ক্যাম্প রয়েছে। বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এগুলির সংবাদ প্রকাশ করেছে অথচ প্রধানমন্ত্রী মোদী দেশকে মিথ্যা কথা বলছেন। আসলে মোদী হিটলারের মতো এই ডিটেনশ্যান ক্যাম্পের সত্য লুকোতে চাইছেন। সরকার আসামে যে 1600 কোটি টাকা খরচ করে এনআরসি করেছে তা বাতিল করবে বলছে তাহলে এত মানুষকে কষ্ট দিয়ে এত টাকা খরচ করে লাভ কি?
সমপরিমাণ অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে খরচ করলে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য মানুষের জীবনের মান কি উন্নত হত না? আসলে সরকার নিজের বিকাশ, উন্নয়ন, দুই কোটি চাকরি দিতে পারছে না। সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ যে ভারতের জিডিপি 9% এর কাছাকাছি থাকত তা আজ 4% এর কাছাকাছি এসে উপস্থিত, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন পুরানো নিয়মে মাপলে তা 1-2% এর মধ্যে জিডিপি থাকবে। বেকার যুবক যুবতিদের হাতে কাজ নেই দেশে ভয়াবহ মন্দা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা, জিনিসপত্রের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, পেঁয়াজের দাম 150 টাকা কেজি, একের পর এক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!
এমতাবস্থায় নিজেদের ব্যার্থতা ঢাকবার জন্য মানুষকে হিন্দু মুসলমান, এনআরসি, সিএএ, রাম মন্দির, 370, পাকিস্তান, বালাকোট ইত্যাদির কথা বলা হচ্ছে। মোদী সরকার ভালো কাজ কিছু করেনি তা বলব না যেমন 370 ধারা বাতিল, তিন তালাক বাতিল অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু একই কথা বলে কতদিন চালাবে। পার্লামেন্টে সকল দল 370 ধারা তুলে দেওয়ার পক্ষে সরকারকে সহযোগিতা করেছিল তবেই সরকারের পক্ষে এই ধারা তুলে দেওয়া সম্ভব হয় কিন্তু এতদিন কাশ্মীরে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা কতটা মানবিক? অন্যদিকে তিন তালাক বাতিল করেছে ভালো কথা কিন্তু যেভাবে দেওয়ানি আইনকে ফৌজদারি আইনে পরিণত করেছে, তাঁর অপব্যবহারের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে সরকারের সেদিকে দৃষ্টি আছে কি? সরকার যদি ইউনিফর্ম সিভিল কোর্ড আনে সমর্থন করব কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে?
আসলে সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য চাই মানুষের মধ্যে ঘৃণার প্রসার ঘটুক মানুষ হিন্দু মুসলমান করুক ও এই সরকারের গদি সুরক্ষিত থাকুক। ভারতের জনগণ কিন্তু এত অবুঝ নয় যে এগুলিতে বার বার ধোঁকা খাবে। তাই গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচানোর এই লড়াই আজ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশের রাজপথে লড়া হচ্ছে। দেশের সমস্ত শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কাছে অনুরোধ আজ আমাদের গণতন্ত্র বাঁচানোর এ লড়াই, সংবিধান বাঁচানোর এই লড়াই, ভারত বাঁচানোর এই লড়াইয়ে সকলে সামিল হোন।
ভারতবর্ষের মাটি রবীন্দ্র নজরুল সংস্কৃতির মাটি। রাম প্রসাদ বিসমিল, আশফাকুল্লা খাঁ, ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুখদেব, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখের মত লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামীর ত্যাগ ও তিতিক্ষার আদর্শের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের মাটি গড়ে উঠেছে! তাই কোন সাম্প্রদায়িক শক্তি আমাদের এই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষকে সাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষে পরিণত করতে পারবে না; আমরা তা হতে দেব না! প্রকৃতপক্ষে আজ আমরা সংকল্প নিয় ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াইয়ে’ ততদিন আমরা লড়াই চালিয়ে যাব যতদিন না এই ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নেয়, ততদিন এই লড়াই চলবে যতদিন না গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, যতদিন না সংবিধানের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়! এ লড়াই গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই, এ লড়াই ভালোবাসার লড়াই, এ লড়াই মানবতা প্রতিষ্ঠার লড়াই, এ লড়াই স্বাধীনভাবে সৌভাতৃত্ববোধ বজায় রেখে মানুষের মতো বাঁচার লড়াই!
তথ্যসূত্র:-
1. উইকিপিডিয়া।
2. এই সময়।
3. গণশক্তি।
4. জিন্না-স্বপন মুখোপাধ্যায়।
5. মেইন ক্যাম্প-অ্যাডলফ হিটলার। (ভাষান্তর: পরিতোষ মজুমদার)
6. বাংলার এনআরসি 1948-মানিক ফকির।
7. National Geographic.
8. Abp News.
9. The Hindu.
Leave a Reply