
লিখেছেন : তানভীর রাফি
ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার মাত্র ৬ মাস পর পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের কণ্ঠকে আরো শক্তিশালী করতে একটা বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের প্রয়োজন ছিলো। ৪ জানুয়ারী, ১৯৪৮ সালে সেই কণ্ঠস্বর ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ গড়ে তোলা হয়েছিলো ফজলুল হক হলের এ্যাসেম্বলিতে একঝাঁক সাহসী তরুণ নিয়ে।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্মদাতা ছিলেন মাত্র ২৮ বছরের এক তরুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমান সময়ে দেখা যায়; কেউ কোনো রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন কিংবা পেশাজীবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলে তিনি নিজেই সংগঠনটির সভাপতি কিংবা প্রধান আহ্বায়ক পদে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ সৃষ্টি করে কোনো পদে অধিষ্ঠিত হননি।
আমার কাছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুইটি অধ্যায়। যেহেতু সময়টা বর্তমান তাই ছাত্রলীগের দ্বিতীয় অধ্যায় দিয়েই আগে শুরু করি…….
মূলত দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের চরিত্র পাল্টাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু যে আশা, স্বপ্ন, চিন্তা নিয়ে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার সমস্ত কিছু ধুলিস্যাৎ হওয়া শুরু করে ধীরেধীরে।
ছাত্রলীগের তান্ডবলীলা এতোই বেশী ছিলো যে, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের দুই জন সাধারণ সম্পাদকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে বহিষ্কার করা হয় শাহজাহান সিরাজকে। ১৯৭৪ সালে বহিষ্কার করা হয় শফিউল আলম প্রধানকে। শফিউল আলমের স্পর্ধা এতো বেশী ছিলো যে বহিষ্কার হওয়ার পর তিনি নিজেই ছাত্রলীগের নতুন কমিটি তৈরী করেন।
বঙ্গবন্ধু একসময় ঠিকই বুঝতে পারেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য ছাত্রলীগের প্রয়োজনীয়তা এখন আর নেই। বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৫ সালে ২৪ জানুয়ারী সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীবলে বাকশাল প্রতিষ্ঠার ফলে আইন অনুযায়ী কার্যত নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। যদিও ‘জাতীয় ছাত্রলীগ’ নামের নতুন সংগঠন ছিলো বাকশালের অংশ। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কার্যত কোনো কর্তৃত্ব ছিলো না। গঠনতন্ত্রও ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর পর জাতীয় ছাত্রলীগ কিংবা সাবেক ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী কোথাও সরাসরি প্রতিবাদ করার সাহস দেখায়নি। অনেকে ঢাবি ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। তবে ছাত্রলীগের অনেকেই অন্য বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে প্রতিবাদ করেছিলো। বাকশালের জন্য ছাত্রলীগের মত ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’ আইনত নিষিদ্ধ হয়েছিলো। কিন্তু নিষিদ্ধ হলেও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথম প্রতিবাদ করে।
১৯৭৬ সালের পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পুণরায় গঠিত হয়। এরপর টানা ২১ বছর তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ছিলো না।
এই ২১ বছরে মধ্যে ছাত্রলীগের কিছু অবদান আছে। সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ১০ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি মোকাবেলায় পালন করেছে অগ্রণী ভূমিকা। সে সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দিনে তিনবেলা নিজ হাতে রুটি তৈরি করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়াও ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী গণ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সক্রিয় হলেও বিপরীতমুখী আচরণও দেখা গেছে। ১৯৮৬ সালে এরশাদের সাজানো পাতানো তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেন। মূলত আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণই এরশাদের স্বৈরাচরী ক্ষমতা আরো পাকাপোক্ত করে। আর তখন মূল দলের জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগও নিশ্চুপ তোতা পাখি হয়ে যায়।
২১ বছর পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মূল রাজনৈতিক দল পুরণায় ক্ষমতার দেখা পায় ১৯৯৬ সালে। ক্ষমতার দেখা পেলেও তাদের আচরণ এখনকার মত এতো হিংস্র ছিলো না। বরং বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যার জন্য প্রতিবাদ করেছে। ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ছাত্রলীগ। বিভিন্ন অন্যায়-অনিয়ম, সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিবাদ সমাবেশ করে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল এই পাঁচ বছরে ছাত্রলীগ কর্তৃত সংগঠিত অন্যায়, অপকর্মের সংখ্যা নেহাৎ কম না। তবে এই সময়ে ছাত্রলীগ হত্যাকান্ড, টেন্ডার-চাঁদাবাজী, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের চেয়ে নারীদের যৌননিপীড়নে বেশী আলোচনায় ছিলো।
১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা দুর্ধর্ষ ক্যাডার ছিলেন জসিমউদ্দিন মানিক। এই নরপশু ১০০ ছাত্রীকে ধর্ষণের ‘সেষ্ণুরি উৎসব’ পালন করেছিলো। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছাত্রলীগ নেতা রাসেল, মামুন বিবস্ত্র ও ধর্ষণের চেষ্টা করে বাঁধন ন্মের এক মডেল অভিনেত্রীকে। ২০০০ সালের ২৮ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক তরুণীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে ধর্ষণ করে সূর্যসেন হলের চার ছাত্রলীগ নেতা। ২০০০ সালের ২১ মে কুড়িল বিশ্বরোডে ছাত্রলীগ নেতা আশরাফ খান ওরফে তুষারের নেতৃত্বে পাঁচ নরপশু এক আদিবাসী গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পুণরায় ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যায় ২০০১ সালে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের ইতিহাসে সবচেয়ে দূর্বিসহ সময় ছিলো। এমনকি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনেও এতো দূর্বিসহ সময় কাটাতে হয়নি। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্র শিবির এর চোখের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র শিবির দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের দুই শতাধিকের উর্ধ্বে নেতাকর্মী প্রাণ হারায় বিএনপি-জামায়াতের ৫ বছরের শাসনআমলে।
ছাত্রলীগ আবারো তার হারানো ক্ষমতা ফিরে পায় ২০০৮ সালে। কিন্তু এবার ছাত্রলীগের আবির্ভাব হয় ভিন্ন বেশে, ভিন্ন চরিত্রে। ঠিক যেন ৭২-৭৪ সালের সময়ের মত। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা লিপ্ত হয় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী আর হত্যাকান্ডের সাথে। গত প্রায় ১১ বছর ধরে ছাত্রলীগ মূলত আলোচনায় এসেছে হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই কিংবা টেন্ডারবাজির কারণে।
এই ১১ বছরে পুরো বাংলাদেশের ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মকান্ডের কথা আজ বাদ দেই। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দিকে নজর দিলে ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই।
গত ১১ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট সহ বিভিন্ন ছাত্রলীগের সরাসরি জড়িত থাকার ঘটনায় হত্যাকান্ড ঘটেছে ২৫ জন শিক্ষার্থীর। শুধু শিক্ষার্থীর হিসাব বাদ দিলে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১২৫ এর অধিক সংখ্যক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাদ দিলে ২৫টি আর বাদ না দিলে ১২৫টি হত্যাকান্ড নিয়ে হয়তো আপনার হয়তো তালগোল লাগছে। বিষয়টা পরিষ্কার করে দিচ্ছি। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কর্তৃক নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্বজিৎ দাসকে। আর এখানে বিশ্বজিৎ দাসের মত বাকীদের ২৫ জন শিক্ষার্থীর তালিকায় রাখা হয়নি।
খুন হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, বুয়েটে ১ জন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ৩ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। আর শিক্ষার্থীর হিসাব বাদ দিলে ৭৪টি। অর্থ্যাৎ ছাত্রলীগের কর্মীরা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করেছে!
সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কাজে ছাত্রলীগকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও বারবার তাঁদের ন্যায্য আন্দোলনে হামলা চালিয়েছেন সংগঠনটির কর্মীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলন কোটা সংস্কারে বারবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। স্কুল-কলেজের কিশোর ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও হেলমেট বাহিনী সেজে সন্ত্রাসী তান্ডব চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
যে ডাকসুর ভি.পির গায়ে পাকিস্তানের এনএসএফ কখনো চোখ তুলে কথা বলার সাহস পায়নি সেই ডাকসুর ভি.পি নুরুকে তার নিজকক্ষে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। এছাড়াও নুরুকে কমপক্ষে ৭ বার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এমনকি নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতেও ছাত্রলীগ দ্বিধাবোধ করেনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের দুইজন সাধারণ সম্পাদককে পদে থাকা অবস্থায় বহিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু কখনো সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক একসাথে বহিষ্কার করেননি। ৪৪ বছর পর আবারও টেন্ডার-চাঁদাবাজী, মাদক ও বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডে বহিষ্কার করা হয়েছে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে।
ছাত্রলীগ কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সর্বশেষ নৃসংস্য হত্যকান্ডের শিকার হন বুয়েটের আবরার ফাহাদ। কোনো গুলিতে নয়, ছুড়ির আঘাতে নয়, মাথা ফাটিয়ে নয়। আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়েছিলো টানা ৫ ঘন্টা পৈশাচিকভাবে পিটিয়ে। নিজেদের ক্ষমতা কতটুকু দানব শক্তিতে পরিণত হয়েছে সেটা এখানেই স্পষ্ট অনুমান করা যায়।
এতোসব অন্যায় অপকর্মের পরেও ছাত্রলীগ প্রতিদিন সেই পূর্বের মতই দানব চরিত্রে অন্যায় করেই যাচ্ছে। এই অন্যায়ের বিপক্ষে মূলত তাদের তিনটি যুক্তি রয়েছে। প্রথম যুক্তি, ভিক্টিম শিবিরের লোক কিংবা ভিক্টিমের চৌদ্দ গুষ্টির কেউ শিবিরের লোক। দ্বিতীয় যুক্তি, যিনি অন্যায় করেছেন তিনি ছাত্রলীগের সাবেক কিংবা বহিষ্কৃত নেতা। তৃতীয় যুক্তি, কোনো একক ব্যক্তির দায় ছাত্রলীগ সংগঠন হিসাবে নিতে পারবে না। (স্বীকার করা ছাড়া উপায় না থাকলে)
এবার বলতে চাই ছাত্রলীগের প্রথম অধ্যায় কথা…….(অতীত ইতিহাস জানা থাকলে স্কিপ করলেও চলবে)
ছাত্রলীগের কণ্ঠস্বর প্রথম গর্জে উঠে বাংলা ভাষা আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সামনে থেকে শুরু হয় ছাত্রলীগের রাষ্ট্রভাষার জন্য প্রতিবাদ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন জোরালো করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল প্রণিধানযোগ্য।
ছাত্রলীগকে সাথে নিয়ে ঢাবির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান গড়ে তুলেছিলেন চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের আন্দোলন। কারণ সে-সময় কর্মচারীদের বেতন ছিল ১১ থেকে ১৪ টাকা। কর্মচারীদের ছিলো না কোনো নিয়োগপত্র। সাথে ছিলো অকারণে চাকরি চ্যুতের হুমকি। এই আন্দোলনে প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলো। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার হন বঙ্গবন্ধু।
এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৬২ সালে তৎকালীন আইয়ুব খান সরকার কর্তৃক গঠিত শরিফ কমিশন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ও স্বার্থের অনুকূলে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল। সেই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা গণআন্দোলন ও গণজাগরণ তৈরি করে।
১৯৬৬ সালে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সনদ ছয় দফা বাস্তবায়নে শেখ মুজিবুর রহমান আস্থা রেখেছিলেন ছাত্রলীগের উপর। ছয় দফা নিয়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে গণজোয়ার তৈরী করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছিল রাজপথের প্রমিথিউস। ছয় দফা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে বিভেদ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে ছাত্রলীগের শক্ত অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সেদিন আওয়ামী লীগের বৈঠকের বাইরে কঠোর পাহারা বসাতে হয়েছিল ছাত্রলীগের কর্মীদেরই।
মুক্তিযুদ্ধের আগে সর্বশেষ ৩ মার্চ ছাত্রলীগকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘দানবের সঙ্গে লড়াইয়ে যে কোনো পরিণতিকে মাথা পেতে বরণের জন্য আমরা প্রস্তুত। ২৩ বছর রক্ত দিয়ে এসেছি। প্রয়োজনবোধে বুকের রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব। তবু সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বাংলার শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করব না।’
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ মুজিব বাহিনী গঠন করে, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং বাংলাদেশ বিজয় লাভে ভূমিকা পালন করে।
.
বঙ্গবন্ধু একসময় খুব গর্ব করে বলতেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস।’
আমি নিশ্চিত ঠোঁটকাটা স্বভাবের বঙ্গবন্ধু এখন বেঁচে থাকলে বলতেন,
‘ছাত্রলীগের বর্তমান ইতিহাস হবে বাঙালির কলঙ্কের ইতিহাস।’
বঙ্গবন্ধু হাতে তৈরী হওয়া এবং বন্ধ হওয়া গৌরব উজ্জলিত, আলোচিত, সমালোচিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ।
Leave a Reply