
লিখেছেন : আকাশ মালিক
যে কোন একটি ঘটনা কিছু সাধারণ পাবলিক একই সাথে একই জায়গায় একই সময়ে প্রত্যক্ষ করে একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপরীত জাজমেন্ট বা বিচার বা মন্তব্য করতে পারে, এটা খুবই স্বাভাবিক। সেটাই ঘটেছে ইউনিভার্সিটি ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায়। কিন্তু পুলিশ গোয়েন্দা বিভাগ আদালত এটা করতে পারেনা। সঠিক জাজমেন্ট সঠিক বিচার আসল সত্য উদ্ঘাটন করারই তাদের কাজ। এ জন্যে পাবলিক তাদের বেতন দেয়, এটিই তাদের জীবীকা। এক সময় বেশ কিছু চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণের কেইস স্ট্যাডি পড়তে হয়েছিল, কিছু ইনটারভিউ নিয়েছি আর নিজের জীবনেও সচক্ষে দু একটা ঘটনা দেখার সাক্ষী হয়েছি। কিন্তু এমন আজগুবি অবিশ্বাস্য গোয়েন্দা পুলিশের কাজ কোনোদিন দেখিনি। খুব সংক্ষেপে আমার নিজের জীবনে ঘটা দুটো ঘটনা আপনাদেরকে শুনাই।
প্রথম ঘটনা ১৯৮৮ সালের। তখন আমি একটি ছোট রেষ্টুরেন্টে ম্যানেজারের কাজ করি। রাত ১২টায় অন্যান্য সকল ষ্টাফ চলে গেছে শুধু আমি আর আমার বস (রেষ্টুরেন্টের মালিক) শেষ কিছু চেক আপ করছি। বাহিরের লাইট অফ করে দিয়েছি, আমার হাতে চাবি দরজা বন্ধ করতে যাবো ঠিক এই সময়ে দুজন লোক ঢুকলো। ভয় পাওয়ার মতো চেহারা। সরাসরি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙ্গীয়ে হুমকি দিল টিলের (ক্যাসবক্স) চাবি দেয়ার জন্যে। আমার সন্দেহ রইলোনা, আজ রাতে এখানে ডাকাতির ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তাদের হাতে কোনো অস্ত্র দেখছিনা তবু ভয়ে শরীর কাঁপছে, গলা শুকিয়ে গেছে। নম্র সুরে তাদেরকে বললাম, এই নাও চাবি আর এখানে আছে টিল, তোমরা সবকিছু নিয়ে যাও কিন্তু কাউকে আঘাত করোনা প্লিজ। সম্ভবত প্লিজ শব্দটাতেই আমার প্রতি তাদের করুণা হলো, বললো এখানে ওয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো তোমাকে আমরা কিচ্ছুই করবোনা। কিচিনে আমার বস তার শেষ কাজটুকু সেরে নিচ্ছিলেন, ডাকাত দুজন কিচেনে চলে যায়। ওয়ালেট (ম্যানিব্যাগ) বের করে না দেয়ার জন্যে বসের সাথে এক দুই মিনিট মারামারি দস্তাদস্তি হয়, এক পর্যায়ে তারা কিচেনের টেবিলের ওপর রাখা বড় লম্বা দুটো ছুরি হাতে নিয়ে খুন করার হুমকি দেয়। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তাতক্ষণিকভাবে বুঝতে পারছিলামনা কী করবো, একটা খুনের সাক্ষী হয়ে এখানে একটা মরা লাশ নিয়ে একা পড়ে রইবো নাকি একটা মানুষকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করবো। আমি দৌড়ে গিয়ে বসকে ধমক দিয়ে উচ্চস্বরে ইংরেজিতে বলি, গিভ দেম ইওর ওয়ালেট, আস্তে করে বাংলায় বলি টাকার চেয়ে তোমার জীবন অনেক মূল্যবান। সর্বমোট ৫ মিনিট স্থায়ী ঘটনা। তারা চলে যাওয়ার পর পুলিশ ডাকলাম, দুই মিনিটে পুলিশ এসে হাজির। একদল আমাদেরকে শান্তনা দেয়ায় ব্যস্ত আরেকদল ডাকাত ধরতে বেরিয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন পথে। আধা ঘণ্টার মধ্যে খবর আসে ‘সাসপেক্ট ধরতে আমরা সক্ষম হয়েছি তোমাদের ওয়ালেট সহ’। তিন মাসের মধ্যে সেই দুই ডাকাতের নাম চেহারা ছবি কোনোদিন পত্রিকায় টেলিভিশনে দেখলামনা। কিচেনের দু্টো ছুরি, কাউন্টারের টেলিফোন সেট সহ আরো কিছু জিনিষ ওরা নিয়েছিল, এ সবের কিছুই আমরা আর কোনোদিন দেখিনি অথচ সবগুলো জিনিষ পুলিশের কাছে ছিল। পুলিশ বললো তোমরা ইন্সুরেন্স থেকে ক্লেইম করে নাও, ওসব দেয়া যাবেনা। সেদিন সেই ঘটনায় পুলিশ স্টেশন আর কোর্টে বারবার আসা যাওয়া করে বুঝতে পেরেছিলাম এ দেশের গোয়েন্দারা নিজেকে কতো সতর্কভাবে সাস্পেক্ট, ভিকটিম, রিপোর্টার ও পাবলিক থেকে লুকিয়ে রাখে। যখন তারা প্রকাশ হয় তখন সারা দুনিয়া জানতে পারে এরা একটি অজানা সত্য উদ্ঘাটন করেছে, একটি ক্রিমিন্যালকে জেলে পুরতে পেরেছে। আর এটি হয় আদালতের সামনে মহামান্য আদালতের রায়ের সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে। তখনই, শুধু তখনই আদালতের সামনে উপস্থিত মিডিয়া জানতে পারে যে, অমুক জায়গায় অমুক দিন একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল, কী ভাবে আর কে ঘটিয়েছিল। ছয় মাস পর পত্রিকায় ছবি সহকারে ছাপা হলো সেই ঘটনা, আর আমার বস ডাকাতদের ছবি দেখে বললেন, এরা বুঝি ছিল? ইনভেস্টিগেশনের রীতি অনুযায়ী পুলিশ ভিক্টিমকে ও সাক্ষীকে (একাধিক সাক্ষী হলে পৃথকভাবে) একাধিকবার আসামীর ছবি অন্যান্য কয়েকজন ক্রিমিনালের ছবির পাশাপাশি বসিয়ে কমপিউটার স্ক্রিনে দেখান। আমার বস তিনবারই ভুল ব্যক্তিকে সিলেক্ট করেছিলেন। অবশ্য আমি প্রথমবারেই সঠিক মানুষটির দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করেছিলাম।
বত্রিশ বছর পর, দ্বিতীয় ঘটনা সাম্প্রতিক গত জুলাই মাসের। আমার বিজনিসের নিকটেই একটি স্পার শপ (SPAR Convenience Store) এর বাহিরের দেয়ালে এটিএম (ATM mechine ) মেশিন আছে। পাশেই বাস স্টপ। সুতরাং এখানে সব সময়ই মানুষের আনাগোনা থাকে। জুলাই মাসের সন্ধ্যা হয় নয়টায়। আমি বিকেল আটটার সময় মেশিন থেকে টাকা তুলতে দাঁড়িয়েছি। ডান হাতে কার্ড আর বাম হাতে ওয়ালেট। মেশিনে কার্ড ঢুকিয়ে পিন নাম্বার দিচ্ছি ওমনি হঠাৎ পেছন দিক থেকে একজন আমার বাম হাতে ঝাপ্টা মেরে ওয়ালেটটি ছিনিয়ে নিতে চাইলো। যতদূর সম্ভব দুই হাতে শক্ত করে ওয়ালেটটি ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। যেহেতু সে আমার হাত নিচের দিকে টানছিল সুতরাং ওয়ার অফ ট্যাগটা হয়েছিল নিচের দিকে ঝুকেই। আরথ্রাইটিজ ডায়েবেটিক্স রোগাক্রান্ত ষাটোর্ধ বয়সের একজন মানুষের পক্ষে ৩০ বছর বয়সের এক তাগড়া যুবকের সাথে কতক্ষণ আর টানাটানি করা যায়। এক পর্যায়ে বাম হাতের কিছুটা অংশ আমার ওয়ালেটের মেটেলযুক্ত কর্ণারের প্রচন্ড ঘষায় কেটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। আমি ওয়ালেট ছেড়ে দেই। আশেপাশে দু একজন বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখছিলেন কিন্তু তারা তাতক্ষণিকভাবে বুঝতেই পারছিলেন না এখানে হচ্ছেটা কী? আমাদের দস্তাদস্তি বড়জোর এক মিনিট স্থায়ী ছিল। শপ থেকে কিছু মানুষ বেরিয়ে এসে আমার হাতের রক্ত দেখে কেউ নিয়ে আসলেন প্লাস্টার আর কেউ টিসু । শপের ভেতরেও সিসি টিভি ক্যামেরা আছে আর অপজিট পাবের বাহিরেও একটি ক্যামেরা আছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ফোন করে পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির। কেউ আমার বিজনিসেও খবরটা দিয়ে দিছে। খবর পেয়ে আমার ছেলে মেয়েরাও এসে উপস্থিত। বিজনিস থেকে আমার ঘরের দূরত্ব আমার জন্যে হেঁটে পাঁচ মিনিট। পুলিশ বললেন তোমরা ঘরে যাও আমরা একটু পরে আসছি। মেয়ে আমাকে গাড়ি দিয়ে ঘরে নিয়ে আসলো। ২০ মিনিট পরে পুলিশ আমার ঘরে আসলেন। কিছু স্যরি কিছু সমবেদনা কিছু কুশলাদি জিজ্ঞেস করে পরে বললেন, ‘সাস্পেক্টকে পুলিশ স্টেশনে রেখে তোমার স্টেইটমেন্ট নিতে আসলাম’। ব্যস পুলিশ এই টুকুই বললো, ইনভেস্টিগেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কিছু বলতে রাজি না। আমি নাছোড় বান্দা, বললাম অন্তত এই টুকু বলো, ১৫ মিনিটে চোরটাকে ধরলেন কেমনে? পুলিশ বললেন, তোমার একটি ক্রেডিট কার্ড একটি দোকানে ইউজ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। পরের দিন পুলিশ ফোন করে বললেন, ‘তোমার ওয়ালেট টাকা ক্রেডিট কার্ড সবকিছু আমাদের কাছে আছে কিন্তু দেয়া যাবেনা’। একদিন আমার ডাক পড়লো, পুলিশ স্টেশনে আসামীকে সনাক্ত করতে হবে। ৬ জন আসামীদের মধ্যে খুঁজে বের করতে হবে আমাকে কে আক্রমন করেছিল। কমপিউটার স্ক্রিনে হাই রেজুলেশনের পরিষ্কার জীবন্ত ছবি। দুই বার দেখে প্রতিবারই বললাম আমার দ্বারা সম্ভব নয় সঠিক মানুষটি বের করা কারণ , সকলের চেহারাই আমার কাছে এক রকম মনে হয়, আমি চাইনা আমার ভুলের কারণে একজন নির্দোষ মানুষ দোষী সাব্যস্ত হউক। পুলিশ হাসি মুখে বললেন, চিন্তার কোনো কারণ নাই, যদি পারো আরেকবার দেখো চিনতে পারো কি না, না পারলেও কোনো অসুবিধে নাই। অনেক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত এক জনের দিকে আঙ্গুল তোলে বললাম ‘মনে হয় উনি’। এই কেইসে তিনজন মহিলা সাক্ষী হয়েছিলেন। তারা তিনজনই আসল মানুষটাকে ছবিতে আইডেন্টিফাই করেছিলেন , শুধু আমি ভুল একজনের দিকে আঙ্গুল তুলেছিলাম। তিন মাস পরে আদালত থেকে চিঠি আসলো আসামীর তিন বছরের জেল হয়েছে আর পুলিশ ফোন করে বললেন, তোমার ওয়ালেট এসে নিয়ে যাও। ওয়ালেটের ভেতরে কিছু জরুরী কাগজ, কিছু ফটো ও কিছু কার্ড আছে কিন্তু টাকা নাই। পুলিশকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন ‘টাকা দেয়া হবে চেকের মাধ্যমে কারণ ঐ টাকায় ফরেন্সিক এক্সামিনেশনের ছাপ আর আসামীর হাতের ফিঙ্গার প্রিন্ট আছে, ওগুলো ভবিষ্যতে আমাদের কাজে লাগতে পারে’।
আগে একটি লেখায় বলেছিলাম,সন্দেহভাজন আসামীর স্বীকারোক্তি আর ভিকটিমের সাক্ষী কোনভাবেই আসামীকে দোষী সাবস্ত্য করার জন্যে যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে আসামীর জবানবন্দি আর ভিকটিমের সাক্ষী যে পরিবেশে যে অবস্থায় যে ভাবে নেয়া হয় তাও এক অদ্ভুত কারবার। তারা যেভাবে জবানবন্দি নেন তাতে একজন সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমদের দেশের পুলিশ যে কতো Inexperienced, Unskilled, আনাড়ি, অদক্ষ, অনভিজ্ঞ তা ইউরোপের কোনো দেশে না আসলে বুঝা যায়না।সমাজের প্রত্যেকটা সেক্টর সাধারণ জনতা থেকে সাংবাদিক, পুলিশ, আমলা, প্রশাসন সবাই এক দুষ্ট ভ্রষ্ট নষ্ট নোংরা রাজনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেছে। পুলিশ ধরে আসামী আর ভিকটিম ধন্যবাদ দেয় প্রধানমন্ত্রীকে। অর্থের জন্যে টাকার জন্যে ওষুধের জন্যে বিচারের জন্যে সবাই হাত পাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আজ মানুষ নিজেকে মানুষ ভাবতে ভয় পায়। তার নিজস্বতা স্বকীয়তা স্বাধীনতা বলতে কিছু আছে তা সে নিজেই জানেনা। আজ যেন মানুষ নিজেকেই নিজের আপন ভাবতে কষ্ট পায়, সে যেন অপরের হয়ে গেছে। তাই আজ সমাজের এই অবস্তা, এর জন্যে সম্পূর্ণ দায়ী রাজনীতিবিদরা যারা রাষ্ট্র চালায় যারা আইন আর নীতি বানায়।
এই কি সেই সিরিয়েল রেইপিস্ট মজনু?
Leave a Reply